এক সময় ঠাট্টা করে বলা হতো, যে লেখা পড়লে কিছুই মানে বোঝা যায় না, তারই নাম আধুনিক কবিতা। সেই রকমই এক সময় এমনই অবস্থা দাঁড়িয়েছিল, যখন, যে লেখা পড়তেই ইচ্ছে করে না, তারই নাম ছিল প্রবন্ধ। সৈয়দ মুজতবা আলীই প্রবন্ধকে সেই অকাল মৃত্যুদশা থেকে বাঁচিয়েছেন।

তিনি অন্তত একশোটি বিষয়বস্তু সম্পর্কে, অন্তত সাতটি ভাষা সেঁচে যে জ্ঞান আহরণ করেছিলেন, তা-ই বিতরণ করেছেন তাঁর রচনায়। তাঁর রচনার পর থেকেই তথাকথিত প্রাবন্ধিকদের দুর্বোধ্য, কষ্টকল্পিত বাক্যের রচনা পাঠকরা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে। যথার্থ পণ্ডিতেরাও এখন আস্তে আস্তে বুঝতে পারছেন, শুধু নিজের বিষয়ের ওপর দখল থাকাই বড় কথা নয়, সাবলীল ভাষায় তা প্রকাশ করতে না জানলে লেখক হওয়া যায় না। একবার বলেছিলেন, পণ্ডিতদের সব ভালো, কিন্তু একটাই দোষ - ব্যাটারা মহামূর্খ হয়!

বিচারপতির মতন একটা উঁচু জায়গায় বসে থাকবেন লেখক, আর সেখান থেকে পাঠকদের উদ্দেশে জ্ঞান বা উপদেশ দান করবেন, সাহিত্যের এই ভূমিকা আর নেই। সারা পৃথিবীতেই পাঠকরা আর সাহিত্যিককে গুরু হিসেবে দেখতে চায় না, বন্ধু হিসেবে চায়। …”

লেখার সময় আমরা ভুলে যাই, আমরা যা জানি, তা প্রতিদিনের প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। আর সেই সত্যটাকে মানতে পারি না বলে, অনর্থক একটা ঝগড়া তৈরি হয় নিজের মধ্যে।

সৈয়দ মুজতবা আলী এক জায়গায় লিখেছিলেন- তিনি চাকরি পেলে লেখেন না! চাকরি না থাকলে লেখেন। এই চাকরি তিনি বারবার কেন খুইয়েছেন, এই নিয়ে একটা গল্পের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। দরখাস্ত নামে একটা রচনায় তিনি লিখছেন, একবার ফ্রান্সে ঢোকবার ফর্মে লেখা ছিল - তোমার জীবিকা নির্বাহের উপায় কী? উত্তরে লিখেছিলুম- কিছুদিন অন্তর অন্তর চাকরি রিজাইন দেওয়া!তা হলে চলে কী করে? তুমি রেজিগনেশনগুলো দেখছ সাহেব, আমি চাকরিগুলো দেখছি! এটা তিনি লিখেছিলেন! আর এটা সত্যি ঘটনা!

একবার আলী, লিখলেন, “পেটের দায়ে লিখছি মশাই, পেটের দায়ে! ... খ্যাতিতে আমার লোভ নেই। যেটুকু হয়েছে, সেইটেই প্রাণ অতিষ্ঠ করে তুলেছে। নাহক্ লোকে চিঠি লিখে জানতে চায়, আমি বিয়ে করেছি কিনা, করে থাকলে সেটা প্রেমে পড়ে না কোল্ড ব্লাডেড, যে রকম কোল্ড ব্লাডেড খুন হয়- অর্থাৎ আত্মীয়- স্বজন ঠিক করে দিয়েছিলেন কিনা? - শবনমের সঙ্গে আবার দেখা হলো কিনা, “চাচা” টি কে, আমি আমার বৌকে ডরাই কিনা- ইত্যাদি ইত্যাদি। এবং কেউ কেউ আসেন আমাকে দেখতে। এখানকার বাঘ সিঙ্গি নন্দলাল, সুধীরঞ্জনকে দেখার পর আমার মতো খাটাশটাকেও এক নজর দেখে নিতে চান! কারণ কোলকাতার ফেরার ট্রেন সেই বিকেল পাঁচটায়; ইতোমধ্যে আর কি করা যায় এবং এসে রীতিমত হতাশ হন...!”

এই ছিলেন আমার গুরু আমার মুর্শেদ, আলী সাহেব!

গঙ্গাজলেই গঙ্গাপুজা সারলাম!