সায়ন্তন হিটারটা আরেকটু বাড়িয়ে দিলেন। বাইরে মাইনাস ২০ ডিগ্রী। মনটা একদম বিশ্রী হয়ে আছে। একটু একা থাকলেই মনে পড়ে যায় স্বাতীর সাথে কাটানো সুন্দর মুহূর্তগুলোর কথা। স্বাতীর পেটের ওপর মাথা রেখে, চোখ বুজে ভেতরের একটি প্রাণের বেড়ে ওঠা অনুভব করার সময়গুলো কি সুন্দর, কি ডিভাইন! মাঝে মাঝে, চোখে ঝিলিক দিয়ে স্বাতীর বলে ওঠা এই দেখ, একটা লাথি মারল এক্ষুনি!

সায়ন্তন এখন অসলোতে। ছুটি শেষ তাই স্বাতীকে একা রেখেই কর্মক্ষেত্রে ফিরে আসা। আর দুমাস পরেই সংসারে আসতে চলেছে একটি নতুন প্রাণ। কিন্তু ওর জন্মের সময় সায়ন্তন কলকাতায় থাকতে পারবে না। নিজেকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে এসেছে সুদূর অসলোতে এই সবে সাতদিন হল। আবার ছুটি ছয় মাস পরে। তাই সায়ন্তন ঠিক করেছে যে সে তার না জন্মানো সন্তানের উদেশ্যে রোজ কিছু লিখবে। একটা ইমেইল আইডি খুলে নিয়েছে, তাতে দৈনিক জমা পড়ে তার মনের কথা, সন্তানের সাথে, স্বাতীর সাথে কাল্পনিক কথোপকথন, খুনসুঁটি, নানা ভাবনার নানা রঙের তুলিতে রাঙানো সেই লাইনগুলো। রোজ লেখে সায়ন্তন, না লিখলে ঘুম আসে না। অনেক বছর পরে, যখন সায়ন্তনের ছানাটি একটু বড় হবে, এই মেলের আইডি আর পাসওয়ার্ড তার হাতে সে তুলে দেবে। বাবা দূরে থেকে কি ভাবত, কি ভাবে ভালবাসত সেটা সে শেয়ার করতে চায়। মাঝে মাঝে স্বাতীকে তার হিংসে হয়। ওই ছোট্ট পুতুলের মতন মানুষটি সবসময স্বাতীর কাছেই থাকবে, মা হবার এটা একটা বড় প্রিভিলেজ। সে প্রিভিলেজ সায়ন্তনের নেই। যখন ছোট্ট মানুষটি সবার কোলে কোলে ঘুরে বেড়াবে, তখন সায়ন্তন সেটা দেখবে ল্যাপটপের স্ক্রিনে।

নেফারতিতি মেইল সার্ভারের একটি ফিফ্যথ জেনারেশন অটোনমাস বট এর নাম। নেফারতিতির কাজ হল মেইলবক্সের মেইল এর ওপর নজর রাখা। দরকারে মেইল পড়া ও সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া। নেফারতিতি দু দিন আগে খেয়াল করেছিল যে সায়ন্তন প্রায় বিগত দশ দিনে কোন মেইল করেনি এই মেইলবক্সে। এই মেইলবক্সে যেহেতু সায়ন্তন ছাড়া আর কারুর মেইল ঢোকে না তাই এই আইডিটা নেফারতিতির জন্য স্পেশাল। নেফারতিতি ঠিক করেছিল যে সে মেইলগুলো পড়ে দেখবে। মেইল পড়া হয়ে গেছে আজ। এক বাবার বুকের পাঁজর নিংড়ানো লাইন। দূরে থাকার যন্ত্রনা, সন্তান আর সন্তানের মা কে কাছে পাবার আকুতি। নেফারতিতি বট হলেও সচেতন... অনুভব করতে পারে, ও সেইভাবেই তৈরি। নেফারতিতি ঠিক করল এই মেইলবক্স যদি তিন বছরের ওপরও না চালু থাকে, তাও সে আইডি অটো ডিলিট করবে না।

বিলিং কাউন্টারের ছেলেটির নজরে এল পুতুলটির ডান হাতের অনামিকার আঙ্গুলটি একটু ফেটে আছে। মেয়েটির মাকে বলল; ম্যাডাম, এই পুতুলটির একটু ডিফেক্ট আছে, আমি আরেকটা পুতুল আনিয়ে দিচ্ছি, একটু দাঁড়ান প্লিজ। কিন্তু কপাল খারাপ, ওই পুতুলটি আর স্টকে নেই। বাচ্ছা মেয়ে আর তার মা। মেয়েটি কিছুতেই পুতুলকে ছাড়বে না। এই আধঘন্টার মধ্যে এই পুতুলটির সাথে তার খুব জোরদার বন্ধুত্ব হয়েও গেছে। সে দোকানের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে পুতুলের একটি নামও দিয়ে দিয়েছে! এরপর কি করে বন্ধুকে ছেড়ে দেওয়া যায়! মা এসব বুঝবে না। একটা আঙ্গুল ফাটা তো কি এমন ব্যাপার, এরকম তো মার নিজের আঙ্গুল কতবার কেটে গিয়েছে! কিন্তু বড়রা বড়দের মতন করেই বুঝতে অভ্যস্ত। তাই মেয়েটির মা মেয়েটিকে আরো ভালো একটি পুতুল কিনে দেবার অঙ্গীকার দিয়ে ডিপার্টমেন্ট স্টোরটি ছাড়লেন। একটি নেমন্তন্ন আছে, সেখানে সময়ে পৌঁছতে হবে। কেউ খেয়াল করল না, বাচ্চাটির গালে লেগে আছে শুকিয়ে থাকা চোখের জলের দাগ।

পুতুলটিকে আর স্টোরে ফেরান হল না। এটিকে এবার ডিসকাউন্ট সেলে ফেলা হবে। একটি ছোট অন্ধকার গোডাউনের এক কোণে বসে থাকা মনখারাপ করা পুতুলটি খেয়াল করল যে তার সোনালী চুলের সাথে জড়িয়ে আছে একটি কালো চুল। তার চুল, যার কোলে চড়ে সে এতক্ষন ঘুরে ঘুরে গোটা স্টোরটি দেখেছে। একটি ছোট্ট শ্বাস ফেলে তার ছোট্ট হাত দিয়ে সে কালো চুলটিকে নিজের চুলের মধ্যে মিশিয়ে দিল। এভাবেই তার জীবনের প্রথম বন্ধুর স্মৃতিকে সে ধরে রাখতে চায়।

খেয়াল করলে দেখা যাবে যে প্রিন্সেপ ঘাটের একদম শেষের সিঁড়িতে বসে আছে একটি তরুণী, হাতে নোটবই আর পেন। বেলাশেষের রোদ্দুর এসে পড়েছে তার মুখে। মাজা রঙ, ছিপছিপে বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। তরুণীর নাম অরুণিমা। ডাক নাম অরু। কলকাতায় বাড়ী, তবে আপাতত হোস্টেলে থাকে, নীলরতন সরকারে ডাক্তারীর থার্ড ইয়ার। এমনিতে অরুণিমা খুবই হাসিখুশি মানুষ কিন্তু আজ সে বেশ আনমনা। হাতের নোটবইতে সে একটি চিঠি লিখছে, বাবার উদ্দেশ্যে। অরুণিমা কখনো বাবাকে দেখেনি। বাবাও অরুকে দেখেননি। অরুর জন্মের আগেই অরুর বাবা মারা যান, দেশের বাইরে। খুব ঠান্ডায় হাইপোথারমিক কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট, একটুও সময় দেন নি। বাবাকে না চিনলেও বাবার নানা কাজ অরুকে উৎসাহিত করেছে। অরুর বাবা ছিলেন একজন সায়েন্টিস্ট। বিজ্ঞানের সাথে অরুর বাবার সমান দখল ছিল আঁকা আর ফটোগ্রাফিতে। সারা বাড়িতে এখনও দেয়াল ভর্তি বাবার কাজ। আজ সকালে অরু বাবার একটি পুরোনো নোটবই পায়, সেটি বাবার সঙ্গী ছিল অসলোতে। নোটবইয়ের শেষের পাতায় একটা ই-মেইল আইডি আর তার পাসওয়ার্ড লেখা ছিল। আইডির মধ্যে ছিল মাই-আনবর্ন শব্দটি। তাই অরু কৌতূহলী হয়ে মেইলটি খোলার চেষ্টা করে। স্বাভাবিক ভাবে মেইল আইডিটির আর এত বছর পরে অস্তিত্ব থাকার কথা নয়, কিন্তু অরুকে অবাক করে মেইলটি খুলল। মেইলের ইনবক্সে গিয়ে অরু স্তম্ভিত হয়ে গেল। বাবার লেখা একত্রিশটি মেইল, সবকটিই অরুকে লেখা। বাবা কেন এত তাড়াতাড়ি চলে গেল সেই নিয়ে বাবার ওপর অরুর অভিমান ছিল। আজ এক এক করে একত্রিশটি চিঠি পড়ে অরুর জমাট বাঁধা অভিমান চোখের জল হয়ে নেমে এল।

মাকে অরু এই মেইলের কথা বলে নি। এটি অরুর নিজস্ব সম্পদ, এর কথা কেউ কোনদিন জানতে পারবে না। ঘাটের সিড়িতে বসে অরু সূর্যাস্ত দেখছিল আর বাবার কথা ভাবছিল। হটাৎ অরুর মনে হল বাবাকে ওর একটা চিঠি লেখা উচিৎ। বাবা ঠিক পড়ে নেবে, এই বিশ্বাস অরুর তৈরি হয়েছিল। সে চিঠি অরু লিখল। বেশি বড় নয়, বেশি আবেগের লেখাও নয়। একদম স্বাভাবিক চিঠি। অনেকদিন পরে লেখার জন্য প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নেওয়া, তারপর অরুর পড়াশুনোর খবর, ওর বেড়াতে যাবার ইচ্ছের গল্প। চিঠি লিখে অরু উঠে গিয়ে দোকান থেকে একটা কোক কিনল। কিছুটা খেয়ে বাকিটা ফেলে দিল। তারপর জল দিয়ে ভেতরটা ভালো করে ধুয়ে জল ঝেড়ে ফেলে চিঠিটা ভেতরে ঢুকিয়ে ঢাকনা ভালো করে আটকিয়ে, বোতলটা গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিল। এমনিতে অরু পরিবেশ সচেতন, গঙ্গায় ময়লা ফেলা তার খুবই আপত্তির কাজ। কিন্তু আজ অরুর সেই কথা মনে রইল না। অরুর মুখে স্মিত হাসি, আজ অনেকদিন পরে বাবার দেখা পেয়েছে সে।

অরুর হাত থেকে কোকের বোতলটা জলে পড়ে কিছুক্ষন ভেসে রইল। তারপর আস্তে আস্তে সে গতি পেল। একটা সামান্য বোতল তার দিকে আর কে নজর দেয়! কিন্তু কেউ নজর দিলে দেখতে পেত যে বোতল চিঠি নিয়ে স্রোতের উল্টোদিকে ভেসে চলেছে।

বেনারসের তুলসী ঘাট। সদাশিব বাবু একটি ডুব দিয়ে উঠলেন। আজ ওঁর ছোট মেয়ের জন্মদিন। গঙ্গায় স্নান সেরে মন্দিরে পুজো দিয়ে প্রসাদ নিয়ে বাড়ি যাবেন। এমন সময় চোখে পড়ল একটি প্লাস্টিকের বোতল ভেসে এসেছে পায়ের কাছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হল বোতলের মধ্যে রয়েছে একটি ভাঁজ করা কাগজ। দুটো সিড়ি নামতেই বোতল চলে এল ওঁর হাতে। ঘাটে উঠে চাতালে বসে বোতল খুলে আঙ্গুল ঢুকিয়ে কাগজটি বার করে আনলেন। সুন্দর হাতের লেখায় একটি চিঠি, ইংরিজিতে লেখা। কোন মেয়ে লিখেছে তার বাবাকে। লেখা দেখে বুঝলেন মেয়েটি ডাক্তারি পড়ে। পড়াশুনোর নানা খুঁটিনাটি বর্ণনা তার সাথে মেয়েটির শখ, বেড়ানোর কথা। সদাশিব বাবু, প্রফেসর সদাশিব খান্ডেলওয়াল কিছুতেই বুঝতে পারলেন না যে এই চিঠি কেন বোতলের মধ্যে এরকম ভাবে ভেসে তার কাছে এল। মেয়েটির মেডিক্যাল কলেজ কলকাতার। কিন্তু কলকাতার গঙ্গার জল তো উজিয়ে বেনারস অবধি আসবে না! কিন্তু চিঠিটা পড়ে সদাশিব বাবু খুব শান্তি পেলেন। হাতের লেখাটিও কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে। শুকনো জামাকাপড় পরে চিঠিটি নিজের পকেটে ঢুকিয়ে পুজো দিতে মন্দিরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।

বাড়ী ফিরতে বেলা হয়ে গেল। ছোট মেয়ে মিনু দৌড়ে এসে বাবার হাত থেকে প্রসাদের চাঙারি নিয়ে নিল। গিন্নী চা আর জলখাবার নিয়ে এলেন। সদাশিব বাবু চা খেতে খেতে গিন্নীকে চিঠির কথা বললেন, চিঠি পকেট থেকে বার করে দিলেন দেখার জন্য। চিঠি দেখার পরই গিন্নীর মুখের রেখার পরিবর্তন ওঁর চোখ এড়াল না। গিন্নীর মুখ থমথমে, চোখে জল টলমল করছে। উনি ফিসফিস করে বললেন এ তো একেবারে আমাদের কস্তুরীর হাতের লেখা, অবিকল একরকম! সদাশিব এবার বুঝতে পারলেন কেন এত চেনা লাগছিল এই হাতের লেখা। একেবারে এক গঠন, এক রকমের টান লেখার।

কস্তুরী সদাশিব বাবুর প্রথম সন্তান, মিনুর দিদি। কলেজ থেকে দ্বিতীয়বর্ষে ফিল্ড এক্সকারশনে গেছিল, সেখান থেকেই নিখোঁজ। তিন বছর আগের কথা। থানা পুলিশ, প্রাইভেট গোয়েন্দা কিছু বাদ রাখেন নি প্রফেসর খান্ডেলওয়াল। উনি বেনারসের একজন প্রভাবশালী মানুষ, কিন্তু তাও খোঁজ মেলেনি কস্তুরীর। বাবা মায়ের আশা মেয়ে একদিন ঠিক ফেরত আসবে। গিন্নী চিঠিটাকে বুকে চেপে ধরে আছেন, যেন মেয়ে চিঠির মধ্যে স্বয়ং বসে আছে, চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়ে চিঠির একটা কোন ভিজে উঠছে। এমন সময় মিনু হুড়মুড় করে ঘরে দৌড়ে এল। মায়ের এই মুখের অবস্থা দেখে সে একটু হতচকিত। তার হাতে ধরা রয়েছে একটি পুতুল, তার দিদির সবচেয়ে প্রিয় খেলার সঙ্গী। পুতুলের ডান হাতের অনামিকায় একটি ব্যান্ড এইড লাগানো।